গত ৭ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়ে যায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে টিকটকে যেসব রাজনৈতিক অপতথ্য বা ভুয়া তথ্য ছড়িয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে এমন ৫টি অপতথ্য নিয়ে এই প্রতিবেদন।গত তিন মাসে নিউজচেকার-বাংলাদেশ ৩০০’রও বেশি ভুয়া তথ্য নথিভুক্ত করে যার অধিকাংশই ছিলো রাজনৈতিক ঘটনা ও ব্যক্তিত্ব সংক্রান্ত। এর মধ্যে কিছু নির্দিষ্ট ভুয়া খবরের আধিপত্যই ছিলো বেশি।
শেখ হাসিনার পদত্যাগঃ
ক্ষ্মতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার প্রধান শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে সবচেয়ে বেশি বার ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভুয়া তথ্য হলো প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগের। কখনো দাবি করা হয়েছে তিনি নিজে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন, কখনো বিদেশী চাপে পদত্যাগ করেছেন আবার কখনো বা সেনাবাহিনীর চাপে পদত্যাগ করেছেন বলে ভুয়া তথ্যগুলো ছড়ানো হয়। এমনই কিছু ভিডিও দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, ও এখানে।
এই ভিডিওগুলোর কোনটিতে দাবি করা হয়েছে সেনাবাহিনীর আদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন, আমেরিকার আদেশে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন, কোন কোনটিতে বলা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী নিজেই পদত্যাগ করছেন। অনুসন্ধান করে দেখা যায় এসব দাবির কোনটিরই ভিত্তি নেই। ভিডিওগুলোতে সেনাবাহিনীর প্রধান, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সহ অন্যান্য ব্যক্তিদের ভিন্ন ভিন্ন সময়ের ছবি বা ভিডিও ব্যবহার করা হয় যার সাথে মুল দাবির কোন সম্পর্ক নেই। কখনো বা প্রথম আলোর ভুয়ো ফটোকার্ড ব্যবহার করে মনগড়া তথ্য জুড়ে দেয়া হচ্ছে। নিউজচেকার-বাংলাদেশ-এর একটি প্রতিবেদন দেখুন এখানে ও এখানে।
“মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসের জামিন”
গত অক্টোবরে পল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশের পর গ্রেফতার হন মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাস সহ আরও উল্লেখযোগ্য বিএনপির নেতারা। গত ২৮শে অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ এর পর ২৯শে অক্টোবর প্রধান বিচারপতির বাসায় হামলার মামলায় গ্রেফতার করা হয় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তার ঠিক দুই দিন পর গ্রেফতার হন বিএনপির আর এক নেতা মির্জা আব্বাস। তাদের গ্রেফতারের ঘটনার পর থেকে টিকটকে মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসের জামিন হয়েছে দাবিতে বহু সংখ্যক ভুয়া ভিডিও পাওয়া যায়। ভিডিওগুলো দেখুন এখানে, এখানে ও এখানে। অনুসন্ধানে দেখা যায় ভিডিওগুলোতে এক বছর পুরনো ভিডিও ক্লিপ ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরেও বিএনপির এই দুই নেতা গ্রেফতার হন। অতঃপর ৩২ দিন পর তাদের জামিন হয়। এই বিষয়ে নিউজচেকার-বাংলাদেশের প্রতিবেদন দেখুন এখানে- মির্জা ফখরুল ও আব্বাসের জামিন নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজবের ছড়াছড়ি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারঃ
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পুর্ববর্তী সময়ে সবচেয়ে আলোচিত কয়েকটি বিষয়ের একটি ছিলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার । সাধারণত নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্ব পালন করে থাকেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। তবে ২০১১ সালে সংসদে এক বিল পাশের মাধ্যমে এই সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। আর এই সরকার ব্যবস্থাকে পুনর্বহাল করার দাবিতে বিরোধী দলগুলো নিয়মিত আন্দোলন করে যাচ্ছিলো। এরই প্রেক্ষিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে নানাবিধ গুজব।
কখনো বলা হচ্ছে ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার করা হচ্ছে, আমেরিকার চাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল করা হচ্ছে, কখনো বা সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এ নিয়ে নিউজচেকার-বাংলাদেশ-এর ফ্যাক্টচেক স্টোরি দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে ও এখানে।
বাংলাদেশের উপর বিদেশী স্যাংশন
নির্বাচনে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি বাংলাদেশের উপর বিদেশি রাষ্ট্র ও সংস্থা দ্বারা নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নিয়েও অনেক গুজব ছড়িয়ে পড়ে। নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি ২০২১ সালে র্যাব এর উপর আমেরিকার স্যাংশন ও গত বছর মে মাসে ভিষা নিষেধাজ্ঞার পর অধিক আলোচনায় আসে। অধিকাংশ ভিডিওগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এমনকি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত গুজবগুলো ছড়িয়ে থাকে।
আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও গণতন্ত্র নিয়ে নানা আলোচনা হয়ে থাকলেও প্রকৃতপক্ষে র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা ও ভিসা নিষেধাজ্ঞা ব্যতীত কোন স্যাংশন আসে নি। এমনকি এ বিষয়ে ফরেন স্টেট ডিপার্ট্মেন্ট-এর মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারও নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট করেছেন যে, আমেরিকা কোন নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পুর্বে তা নিয়ে আলোচনা করে না। স্যংশন নিয়ে ছড়ানো গুজব নিয়ে আমাদের ফ্যাক্টচেক স্টোরি দেখুন এখানে- স্যাংশন নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে অপতথ্যের ছড়াছড়ি ও বাংলাদেশের উপর নতুন কোন নিষেধাজ্ঞা দেয় নি আমেরিকা।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে গুজব
নির্বাচনকালীন সময়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ছড়িয়েছে একাধিক গুজব। কখনো বা সেনাবাহিনীর উপর জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশন, কখনো বা সেনাবাহিনীর হাতে শেখ হাসিনার ক্ষমতা হস্তান্তর এমনকি সেনাবাহিনী নির্বাচনের দায়িত্ব গ্রহণ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব পালন নিয়ে গুজব ছড়িয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে এসকল দাবিসংক্রান্ত ভাইরাল ভিডিওগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। এছাড়াও গত ডিসেম্বরে ১৪১ সেনা কর্মকর্তা নির্বাচনী তফসিল বাতিল চেয়ে বিবৃতি দেয়ার একটি ভুয়া খবর ছড়িয়ে পড়ে টিকটকে। যেখানে ১৪১ জন অব. সরকারী কর্মকর্তার বিবৃতিকে সেনা কর্মকর্তার বিবৃতি বলে ছড়ানো হয়। এ বিষয়ে আমাদের ফ্যাক্টচেক দেখুন এখানে।
নিউজচেকার-বাংলাদেশ এর এ সংক্রান্ত ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন দেখুন এখানে— তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নির্বাচন কমিশনকে কোন স্বারকলিপি দেয় নি।
উপরিউক্ত ঘটনা ও ব্যক্তিবর্গকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টিকটকে নির্বাচনকালীন সময়ে সবচেয়ে বেশি ভুয়া খবর ছড়ানো হয়। এছাড়াও বিরোধীদল নেত্রী খালেদা জিয়ার মৃত্যু, তারেক রহমান এর দেশে ফিরে আসা ও বিরোধী দল বিএনপির একাধিক নেতৃবৃন্দকে জড়িয়ে ভিত্তিহীন ও সুত্রহীন বহুসংখ্যক অডিও প্রচার করা হয়।
সন্দেহজনক কোনো খবর ও তথ্য সম্পর্কে আপনার প্রতিক্রিয়া জানাতে অথবা সত্যতা জানতে আমাদের লিখে পাঠান [email protected] অথবা whatsapp করুন- 9999499044 এই নম্বরে। আমাদের WhatsApp চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এখানে ক্লিক করে।এছাড়াও আমাদের সাথে Contact Us -র মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারেন ও ফর্ম ভরতে পারেন।